মোদের গরব মোদের আশা হে মোর বাংলাভাষা। সত্যি বাংলাভাষা আমাদের গর্বের। কিন্তু এমনি এমনি এই ভাষা আমাদের গর্ব হয়নি। এর পেছনে আছে বহু মানুষের আত্মত্যাগ। আমরা ১৯৫২ সালে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবী জানাবার জন্য অত্যাচারী পাকিস্থানের খান সেনার হাতে মৃত্যু হয় বরকত,সালাম, জব্বর এরমত বহু মানুষের। জাদের নাম আমরা আজও জানিনা কিংবা বলাভাল জানার চেষ্টা করিনা। সে কারনে ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে বাংলাদেশে প্রচুর রাজবংশী মানুষের আত্মত্যাগ আমাদের জানা নেই।
আমরা জানি যে প্রধানত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কে কেন্দ্র করেই এই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত।কিন্তু এই কথাটি পুরোপুরি সঠিক বলা জায়না কারন ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশে হয় ১৯৫২ সালে। আর ১৯৪৮ সালে বাংলাদেশের উত্তরপ্রান্তের জেলা রংপুরের বিখ্যাত কারমাইকেল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বারাই সেখানে ততকালীন পূর্বপাকিস্থান মানে আজকের বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার আন্দোলন শুরু হয়।
আর এই কারমাইকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় সবচেয়ে বেশী উদ্যোগী হয়েছিল রংপুরের রাজবংশী সম্প্রদায়ের আপামর মানুষ। এপ্রসঙ্গে বলে রাখাভাল মনিষী পঞ্চানন বর্মার সামাজিক সংস্কারের কাজ কিন্তু শুরু হয়েছিল এই রংপুর থেকে। ফলে এখানকার রাজবংশী সহ অন্যান্ন সম্প্রদায়ের মানুষের উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহ ছিল সমগ্র বাংলাতো বটেই এমনকি সারা ভারতবর্ষের মধ্যে বেশী। ফলে সেই সময় কারমাইকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য জারা জমি স্বেচ্ছায় দান করেছিলেন তাদেরমধ্যে বেশীরভাগই ছিল রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ।
আর এই কারমাইকেল কলেজই ছিল বাংলাভাষা আন্দোলনের আতুর ঘড়। দেশভাগের পর বাংলাদেশ জিন্না আর নেহেরুর কুটনীতির ফলে অর্ন্তভুক্ত হয় পাকিস্থানে। পাকিস্থান সরকার জোড় করে বাংলাভাষার ওপর চাপিয়ে দেয় উর্দু ভাষা। ফলে চুপ করে বসে থাকতে পারেনি কারমাইকেল কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা। আর এক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে ঢাকায় বাংলাভাষা রাষ্ট্রভাষা করা নিয়ে আন্দোলন হয়েছিল ১৯৫২ সালে। আর সেখানে বাংলাভাষা কে রাষ্ট্রভাষা করা নিয়ে রংপুরের কারমাইকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন শুরু করে ১৯৪৮ সালে। আরতাই বলা চলে বাংলাভাষা নিয়ে বাংলাদেশের আন্দোলনের ভিত্তিভূমি এই রংপুরের কারমাইকেল কলেজ।
বাংলাদেশের রংপুর জেলা প্রধানত রাজবংশী সম্প্রদায় ভুক্ত অধুষ্যিত জেলা। আর মনিষী পঞ্চানন বর্মার সামাজিক সংস্কারের ফলে শুধুমাত্র এখানকার রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষেরাই নয় সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষই এজেলায় শিক্ষ্যা, সংস্কৃতি, সাহিত্যে বাকী বাংলাদেশের থেকে অনেকটাই এগিয়েছিল। ফলে সেই সময় কারমাইকেল কলেজের বেশীর ভাগ ছাত্র ছাত্রীরাই ছিল রাজবংশী সম্প্রদায়ের। এ প্রসঙ্গে যে নামটি প্রথমেই বলতে হয় সেটি হল সাবিত্রী বর্মনের নাম। সাবিত্রী বর্মন ছিলেন কারমাইকেল কলেজের মেধাবী রাজবংশী সম্প্রদায়ের এক ছাত্রী। জিনি কিনা উর্দুকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে একদমই মানতে পারেননি।সাদা কাগজে লাল আলতা দিয়ে বাংলাভাষার সমর্থনে পোষ্টার লিখে তারপর সেই পোষ্টার কলেজের দেওয়ালে বান্ধবীদের নিয়ে তিনি লাগাতেন। সাবিত্রী বর্মনের সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী ছিলেন কারমাইকেল কলেজের আরেক মেধাবী ছাত্রী বাংলাভাষা আন্দোলনের আরেক উজ্জল নাম মিলি চৌধুরী।একদিন মিলি চৌধুরী ঠিক করলেন আদালতের কাজ বাংলাভাষায় হবার দাবীতে তারা আদালতে গিয়ে জজ সাহেবের কাছে বিক্ষোভ দেখাবেন। তার এই কথা শুনে এগিয়ে এলেন সাবিত্রী বর্মন।
আদালতে বিক্ষোভ দেখবার জন্য মিলি চৌধুরীর সাথে সাবিত্রী বর্মনও সংগঠিত করলেন কারমাইকেল কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের। এরপর তারা আদালতের রায়ের কপি উর্দু বা ইংরাজীতে না লিখে বাংলায় করার দাবী নিয়ে চললেন রংপুর আদালতের দিকে। পুলিশের নিরাপত্তা ভেংগে তারা একদম ঢুকে পরল আদালতের ভিতরে। সোজা এজলাশে বিচারকের মঞ্চে উঠে বিচারকের সামনে মিলি চৌধুরী, সাবিত্রী বর্মনরা তুলে ধরলেন তাদের দাবীপত্র।
এরপর আরও বেশী সংখ্যক পাকিস্থান পুলিশ এসে মিলি চৌধুরী, সাবিত্রী বর্মন ও তাদের আন্দোলনের সাথীদের গ্রেপ্তার করতে এলে বিচারক নিজে মিলি চৌধুরী, সাবিত্রী বর্মন দের মাতৃভাষার প্রতি টান দেখে পুলিশদের নির্দেশ দেন যাতে মিলি চৌধুরী, সাবিত্রী বর্মন ও তাদের সাথীদের গ্রেপ্তার না করা হয়।