উত্তরের প্রানের ভাষা কে গত ২১ ফেব্রুয়ারি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী স্বীকৃতি দেবার কথা বললেন। কিন্তু এই ভাষার নাম কি? কেউ বলছে রাজবংশী ভাষা আবার কেউ বলছে কামতাপুরি ভাষা। যদিও শুধুমাত্র রাজবংশী সম্প্রদায় নয় এই ভাষায় ভারতবর্ষে কথা বলে এছাড়া রাভা, ধীমাল ও অন্যান্য বেশকিছু বাংলাভাষী সম্প্রদায়। বাংলাদেশে এই ভাষায় কথা কয় নশ্য শেখ, বাগদি, নমশূদ্র, সাঁওতাল সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ। বাংলাদেশের মানুষ একে রংপুরিয়া ভাষা বলে। তাহলে এ ভাষার নাম কি?
সবাই কিন্তু একটা কথা ভুলে যাচ্ছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুপ্রেরনাতে বরেন্দ্রভূমি ইতিহাস অনুসন্ধান এর মত উওরের এই অঞ্চলের ইতিহাস অনুসন্ধান করতে নেমে প্রথম এই ভাষার ইতিহাসের বিবরন করেন মনিষী পঞ্চানন বর্মা। হারিয়ে যাওয়া যুগীর গান, গোবিন্দ মিশ্রের গীতা খুজে পেয়ে আবার নতুন করে লিপিবদ্ধ করেন পঞ্চানন বর্মা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় ভাষাবিদ সুকুমার সেন উত্তরের এই ইতিহাস,সাহিত্য, সংস্কৃতির গৌরবময় ইতিহাস উদ্ধারের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দেন মনিষী পঞ্চানন বর্মা কে। মনিষী পঞ্চানন বর্মা এই ভাষাকে কমতাবিহারি ভাষা বলে উল্লেখ করে এই ভাষায় তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ডাংধারী মাও রচনা করেন। এছাড়া এইভাষায় অনেক ঐতিহাসিক প্রবন্ধ রচনা করে মনিষী পঞ্চানন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, অক্ষয়কুমার মৈত্র, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এর ভূয়সী প্রশংসা আদায় করে নেন।কিন্তু কেন এই ভাষাকে মনিষী পঞ্চানন কমতাবিহারি ভাষা বলে চিহ্নিত করলেন কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি, বংগীয় সাহিত্য পরিষদের তথ্য খুঁজলে দেখা যায় উত্তরের রাজবংশী সম্প্রদায় আদপে হিন্দু ধর্মের বীড় ক্ষত্রিয় জাতি। পরশুরাম জখন ক্ষত্রিয় নিধনে উন্মত্ত তখন কিছু ক্ষত্রিয় পরশুরাম এর আক্রোশ থেকে বাচতে কামরুপ অঞ্চলের প্রাকজোতিষপুর ছারিয়ে পালিয়ে আসে। ফলে ক্ষত্রিয়দের মধ্যে মহাভারতের সেই বীড় গাথাগুলি থেকে যায়। কিন্তু কালের ক্রমে তারা সেই ইতিহাস ভুলতে থাকে কিন্তু গোবীন্দমিশ্রের গীতা এই ক্ষত্রিয়দের ইতিহাস বহন করে যায়। একসময় হারিয়ে যায় এই গোবীন্দমিশ্রের গীতা। রাজবংশী কবি রংপুরের রতিরাম দাস রাজবংশী ক্ষত্রিয়দের বীড় গাথা অবলম্বনে রচনা করেন যুগীর গান। একটা সময় হারিয়ে যায় এই যুগীর গানও। বহুপরিশ্রম করে এই গোবিন্দ মিশ্রের গীতা ও রতিরাম দাসের যুগীর গান মনিষী পঞ্চানন বর্মা উদ্ধার করেন। যেহেতু রাজবংশী সম্প্রদায় আদপে ক্ষতিয় তাদের আদিপুরুষ রা ছিলেন আর্যাবর্তের বীড় তাই তাদের আদি বাসভূমি আর্যাবর্তের। আমরা দেখি উত্তরভারতের ক্ষত্রীয় রাজপুতদের ঠাকুর বলা হয় তাই সর্বভারতীয় ক্ষত্রীয়সভা রাজবংশী সম্প্রদায়ের বীড় সন্তান মনিষী পঞ্চানন বর্মাকে ঠাকুর উপাধি দেন। সেই ফল স্বরুপ রাজবংশী রা পরশুরামের কারনে প্রাগজোতিষপুর ছারিয়ে চলে যাবার বহু বছর পর এই উত্তরের জনপদে বিহার করা মানে ঘুরতে এসে সর্বপ্রথম বসতি স্থাপন করেন। সেই অর্থে উত্তরের এই জনপদের প্রতিষ্ঠাতা রাজবংশী সম্প্রদায়। রাজবংশী দের একটা শাখা আবার আর্যাবর্তের থেকে পালিয়ে অবিভক্ত বাংলার দিনাজপুর অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। যেহেতু এরা পরশুরাম এর ভয়ে পালিয়ে এসেছিল তাই তারা পালিয়ে আসার জন্য পালিয়া সম্প্রদায় নামে পরিচিত লাভ করে এরা বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করে বৌদ্ধ বিহারের বাস করে অনেক এখানকার জনজাতির অনেক পূর্ব ইতিহাস রচনা করেন। এইকারনে মনিষী পঞ্চানন বর্মা ক্ষত্রিয়দের আদি ইতিহাস মনে করিয়ে দিয়ে এই অঞ্চলের ভাষাকে কমতাবিহারি ভাষা বলে চিহ্নিত করেন। আর এই পালিয়া সম্প্রদায়কে তিনি পূর্ব ইতিহাস স্বরন করিয়ে দিয়ে তাদের পৈতাদিয়ে আবার বৃহৎ রাজবংশী সম্প্রদায়ে আবার ফিরিয়ে আনেন। আর মনিষী পঞ্চানন বর্মার এই কমতাবিহারি ভাষাতেই সাহিত্য রচনা করেন বাংলার নারী জাগরনের অন্যতম পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া। রংপুরের সদ্য প্রয়াত কবি সৈয়দ সামশুল হক এই ভাষাতেই কবিতা রচনা করে জনপ্রিয় হন।তার বিখ্যাত নূরদীনের ফিরে আসার কথা কবিতার সেই বিখ্যাত লাইন -‘ জাগো বাহে কোনঠায় ‘. আমাদের সবাইকে মনে করিয়ে দেয় মনিষী পঞ্চানন বর্মার সেই কমতাবিহারি ভাষার কথাকেই।কিন্তু মনিষী পঞ্চানন বর্মা প্রেমী এক মানুষ হয়ে আমি খুব বেদনাহত যে কাউকেই এমন কি এই ভাষার স্বীকৃতির আনন্দে জারা মনিষী পঞ্চানন বর্মার ছবি নিয়ে মিছিল করলেন তারাও একবার তুললেন না মনিষী পঞ্চানন বর্মার সেই কমতাবিহারি ভাষা কে। এমন কি রাজবংশী ভাষা একাডমির চেয়ারম্যান মাননীয় বিজয়ভূষন বর্মন বাবুর মত একজন সত, পন্ডিত মানুষও এইভাষার স্বীকৃতির কথা বলতে গিয়েও ভুলে গেলেন মনিষী পঞ্চানন বর্মার অবদান ও তার সেই কমতাবিহারি ভাষাকে। মনিষী পঞ্চানন প্রেমী সকল মানুষ ও মনিষী পঞ্চানন বর্মার প্রতিষ্ঠিত ক্ষত্রিয় সমিতির কাছে একবার ভেবে দেখার অনুরোধ করছি মনিষী পঞ্চানন বর্মার সেই কমতাবিহারি ভাষার কথা তুলে ধরতে আর তা না বললে আমরা কি আদপেই মনিষী পঞ্চানন বর্মাকে ভালবাষি সেটা নিয়ে এক বড় প্রশ্নচিহ্ন থাকবে? কারন উত্তরের ভাষা, সংস্কৃতি, আবেগ, লোকগাথা ঐতিহ্য মনিষী পঞ্চানন বর্মা কে বাদ দিয়ে একদম অচল।